Try to Live till Live the World
  স্বপ্ন অলীকে জাগরণী সেতুবন্ধন
 
১.
পরবাসী মননে শান্তি-স্বপ্ন-বাস্তবতা (ক)

-ফজলে এলাহি মুজাহিদ

স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে (ধারাবাহিক সত্য ঘটনাবলী)
=============================
'প্রবাস মানেই পরবাস' আর 'পরবাস মানেই পরাধীন'; এ উক্তিদ্বয়ের মাঝে প্রথমোক্তটিতে কোন দ্বিমত নেই, কিন্তু বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে একমত হতে পারছি না দ্বিতীয়োক্তির সাথে। সেই তো এসেছিলাম ঢাকায় থাকব বলে, এর আগে আসা হত প্রতিটি গ্রীষ্মের ছুটিতে, এসএসসি হয়ে গেল তাই ইচ্ছে ঢাকাই কলেজে পড়ব, বাবা ঢাকায়, ছোট ভাইটিও ঢাকায়, আমিও যদি ঢাকাই হয়ে যাই তো পিচ্ছি ভাইটি আর তার চেয়েও পিস্কি আদরিণীটারে নিয়ে মা একলা থাকবেন কি করে? তাই ভাবনাচিন্তাদের গুটিয়ে, গুটিয়ে নিলাম বাক্সপেটরা, উঠা হলো ভাড়া বাসায়, প্রথম দিনেই পেয়ে গেলাম এক 'মামাবন্ধু', ঐ এলাকার শেষ দিন পর্যন্ত সে-ই ছিল বন্ধু। রোমান্সকর প্রতিটি সেদিনের কথা আর কি বলবো, ব্লগছবিতেই কি অনেকটা পরিস্কার নয় কি?

বরাবরই হৈ চৈ আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা ছিল স্বভাব বিরুদ্ধ, তাই এলাকার দঙ্গলগুলোর সাথে খুব একটা মিশতে পারতাম না; যদিও মাঝে মাঝে চাইতাম মিশি, আড্ডা দেই, বন্ধুত্বপূর্ণভাবেই থাকি, হয়ে উঠতে না অপছন্দনীয় ওদের কথাবার্তা আর কর্মাদির কারণে, তবুও ওদের প্রিয়ভাজন হয়ে থাকতে পারলাম না। ওরা অন্ততঃ দু'বার দশ/বার জনের বিশাল দল নিয়ে পথ আটকালো আর সদুপদেশ (?) দিল, যেন ওদের সাথে মিলে মিশে থাকি, বন্ধুত্ব করি। পন্থার প্রতিবাদ কি করে করি বলুন, একজন অস্থায়ীর সাথে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্য থেকে এলো দশ/বারজন। মনে মনে হাসলামও খুব। পরবর্তীতে কারণ খুঁজে যা পেলাম, তা হলো ওদের 'ইয়ে'জনেরা আমার প্রশংসার ষষ্টমুখ, তাই এত ঈর্ষা আর বীরত্ব প্রদর্শন। শুরুতেই এই অপ্রাসঙ্গিক কিচ্ছার কারণ হিসেবে বলব- ভাবুন, স্বদেশের পরিবেশে কতটা স্বাধীন ছিলাম।

তাই মাঝে মাঝে প্রবাসী বন্ধুদের আড্ডায় সকলেই একমত হই- 'কত শান্তিতেই না কাটালাম বারটি বছর'। তারপরও যে অশান্তি ও যুলুম নেই বা ছিল না, তা নয়; তবুও তুলনা করতে গেলে মহাশান্তি; সন্দেহ নেই। বারটি বছরে কোনদিন পকেটমার ধরেনি, চলতে পথে মাথার চুলে হাত দিয়েছি বলে গুন্ডাদের আত্মসম্মানে (?) বাধেনি, দিনরাতের যেকোন সময়ে যেখানে সেখানে চলতে মনে এতটুকু ভয় আসেনি; যদিও বছরে দু'একটি ব্যতিক্রম ঘটনা প্রায় বিভিন্ন এলাকা থেকেই আসে, তবুও যেখানে স্বদেশের স্বাধীন মাটিতে প্রতিটি দিন ঘর থেকে বেরুতে ভাবতে হতো- 'ফিরবো তো?'; সে তুলনায় সত্যভাষণে নিতান্তই নগন্য ঠেকে অযাচিত ঘটনাগুলো।

বলছিলাম এত এত শান্তিময়তার পরেও যেসব অন্যায়-যুলুমের শিকার হয়ে থাকি আমরা প্রবাসীরা, তার একটা হলো 'কফিল' বা তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ হতে বেতন না দেয়া, জোর খাটিয়ে কাজ আদায় করানো, পছন্দ না হলে অন্যত্র না যেতে দেয়া ইত্যাদি। শেষটির শিকার হয়েছিলাম প্রায় কয়েকবার; অন্যায় সহজেই হজম হয় না বিধায় বর্তমানে স্পন্সর নং-৫ অতিবাহিত করছি; তাও যাই যাই পর্যায়ে। তো দ্বিতীয় জনার বেলায় হজ্জে যেতে দেবে না, ইচ্ছানুযায়ী কাজ দেবে না, পরিবর্তনেরও সুযোগ দেবে না; এসব কারণে আচ্ছা বাঁকা বেঁকে বসলাম। অবশেষে হয়ে গেল রাগারাগির এক দফা, কাজ করবো না তো করবোই না; সময় বেঁধে দিল কিছুদিন, 'এর মাঝে পরিবর্তন করে নাও'। দেরী হওয়াতে না জানিয়েই 'Exit' সিল মারিয়ে নিল পাসপোর্টে আর জানিয়ে দিল- 'দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নাও'। কিছুটা বিব্রত হলাম, কারণ তখন আমি মোটেও প্রস্তুত নই।

ছবির জন্য
কৃতজ্ঞ যেখানে। ছবিটি সৌদি আরবের ইয়ানবো এলাকার; উল্লেখিত ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপট যেখানে।

পরবাসী মননে শান্তি-স্বপ্ন-বাস্তবতা (খ)
 

শুরু হলো তদবীর, দিনে যোগাযোগ, ফোন ও অন্যান্য নিতান্তই আত্মসম্মানবোধ বজায় থাকামূলক প্রচেষ্টা এবং রাতে 'সালাতুল ইস্তেখারা'; কারণ, শক্তিমানদের যুলুমের শিকার যখন এমন কেউ হয়, যেখানে তার এর বাইরে কিছুই করার থাকে না, তখন মাথা গরম করে সিদ্ধান্তে পৌঁছার চাইতে ধৈর্য্যই সঠিক পন্থা। 'এক্সিট সীল' পড়ার পর পাসপোর্টধারীকে এমাসের মধ্যেই দেশ ত্যাগ করতে হবে, অথচ একমাস পূর্ণ হওয়ার আর মাত্র তিন/চার দিন বাকী। বন্ধুদের সাথে চলে আমার খুবই সাধারণ আলাপচারিতা, হাসিতামাশা, একথায় সবকিছুই স্বাভাবিক; অনেকেই আশ্চর্য হয়ে বলে- 'ফজলে এলাহি ভাই, আপনার এতবড় বিপদ, আপনি কয়েকদিনের মধ্যে দেশে যাচ্ছেন নিতান্ত অনিচ্ছায়, অথচ আপনি দিব্যি হাসছেন, কিভাবে পারছেন?'

বলি- 'কেন হাসবো না, আমার প্রতিপালক যদি আমার জন্য এদেশে আরো রিয্ক রেখে থাকেন, তো পৃথিবীর এমন কোন শক্তি নেই যে, আমাকে এখান থেকে বের করে দেবে। আর যদি তিনি আমার জন্য এদেশ থেকে ক'দি পর বের হওয়া নির্ধারণ করে থাকেন, তো পৃথিবীর কারো সাধ্য নেই যে, আমাকে এখানে এক মুহূর্তও ধরে রাখবে; অতএব চিন্তা কি, আমার প্রতিপালনের দায়িত্ব তো তাঁরই(আল্লাহর)।' তো অবশেষে একদিন সালাতুল ফজরের পর সূর্যোদ্বয়ের অপেক্ষায় থাকলাম, তারপর ইস্তেখারার সালাত আদায় করে ঘুমিয়ে পড়লাম। স্বপ্নে আসলো স্পন্সরের অফিস কক্ষ, টেবিলে বসা স্পন্সর আর পাশে দাঁড়ানো তার মিসরী ড্রাইভার, তত্ত্বাবধায়ক পাশ ফিরে স্পন্সর পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি কাগজ আমার হাতে দিয়ে বললেন নতুন স্পন্সর যেন তার নিকট ফোন করেন।

ঘুম ভাঙ্গলো, মনে মনে আল্লাহকে বললাম- যেন সত্যি হয়। দিন চলে গেল, প্রতিদিনের মতই বন্ধুর দোকানে বসে বসে গল্প করে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ বন্ধুর ফোন বেজে উঠলো, খোঁজ করলো আমাকে, বললো তাড়াতাড়ি চলে আস অমুকের দোকানে। গিয়ে দেখি এ অফিস নয় বরং ইয়ানবোর কাঁচা বাজারের রাস্তাটি, রাস্তার একপাশে দাঁড়ানো তত্ত্বাবধায়কের গাড়ী, সে গাড়ীতে বসা আর তার ড্রাইভার গাড়ীর পাশে দাঁড়ানো, পাশ ফিরে আমার হাতে প্রয়োজনীয় তিনটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ঠিক স্বপ্নের সবকিছুর মতই বললেন- নতুন স্পন্সরকে বলতে যেন তার নিকট ফোন করেন। আমি স্তম্ভিত! মনে মনে সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কি আশ্চর্যভাবে মিলে গেল স্বপ্নের সাথে বাস্তবতা, শুধু স্বপ্নে ছিল অফিস কক্ষের চেয়ার টেবিল আর এখানে গাড়ী, চরিত্র তিনজন মিললো, কাগজ তিনটি মিললো, অবস্থানও মিললো, এমনকি পার্শ্ব ফেরা এবং কথাটাও হুবহু মিলে গেল। সোবহানআল্লাহ্।

সেদিনের পর থেকে আমার ঈমান আরো দৃঢ় হলো যে, দয়াময় আল্লাহর নিকট প্রাণের নির্যাস মিশিয়ে কিছু চাইলে তিনি ফিরিয়ে দেন না; আজ না হোক কাল তা দেবেনই, নিশ্চিত। প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীও সত্যে পরিণত হলো, যেমনটি তিনি বলেছেনঃ ((যখন তোমাদের মধ্যে কেউ কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছা করে, সে যেন দু'রাকা'আত নফল সালাত আদায় করে এবং এ দো'আ পড়ে. . . . (ইস্তেখারার দো'আ)।)) [ইবনে মাজাহঃ ১৩৮৩]। ইস্তেখারা বলতে বুঝায় 'কল্যাণের ইঙ্গিত প্রার্থনা'। প্রবাসের দ্বিতীয় বছরও যখন ব্যবসা শুরু করবো কি করবো না, ভাল হবে না মন্দ হবে; তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম, তখন ইস্তেখারার মাধ্যমে স্বপ্নে দেখতে পেলাম যে, আমি সেই ব্যবসাই করছি, তারপর যতদিন করলাম ভালই পাওয়া হলো। সুতরাং মুমিনদেরও উচিত সব ভালকাজের পূর্বে ইস্তেখারা করা এবং অন্য মুমিনদের সাথে পরামর্শ করা। কারণ, 'যে ব্যক্তি সৃষ্টিকর্তার নিকট ইস্তেখারা করে এবং সৃষ্টজীবের মাঝে মুমিনদের সাথে পরামর্শ করে আর তার কর্মে দৃঢ়পদ থাকে, সে কখনো অনুতপ্ত হয় না।'

ছবির জন্য কৃতজ্ঞ যেখানে। ছবি ইয়ানবো পাওয়ার প্লান্ট, তৈল শোধনাগার ইত্যাদির; রাতের এই আলোক মনোরমতা আমি দারুন উপভোগ করতাম।

২.
পর্বতের পাদদেশীয় বুবিনী -স্বপ্নে

লোকে বলে বোবা ভূত; তাই আমিও বলি, আবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করে নিতাম তাদের বংশীয় ভাল নাম কি; অবশ্য সে সুযোগই থাকে না, কেননা ও বেটা/বেটি ধরলে এমনভাবে চেপে ধরে যে, তার পিতৃপুরুষের নাম জিজ্ঞেস করা তো লক্ষ কিলোমিটারের পথ; ঠিক মত নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। যদি কোনমতে হাতপা ছুঁড়ে একবার নড়ে উঠা যায় অথবা আশপাশে ঘুমিয়ে থাকা কেউ সাহায্য করে তবেই নিস্তার। একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার মত নয়; তাদের জন্য আমাদের পিতৃপুরুষেরাও এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন নাম প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জীবনে তো অন্ততঃ কয়েকবার তাদের সাথে যুদ্ধ হয়ে গেছে; করবেনই বা না কেন।

এই তো বছর পনর আগে সশ্মানের উপর গড়ে উঠা স্কুল হোস্টেলে ঘুমিয়ে, পাশেই পরানপুরের টিটু; বন্ধু ও সহপাঠী, তখনকার হোস্টেলে ভোররাতে উঠে পড়াটাকে রীতিমত উপভোগ করতাম, সেদিন ছিলাম ঘুমিয়ে, নিশ্চয়ই ভোর রাতই হবে, ঘুম ভেঙ্গে গেল ক্রমাগত গোঁঙানীতে। জেগে দেখি টিটু দাঁতে দাঁত পেশাপেশি করছে আর প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছে, লড়াটা বুঝলাম শরীরের মোচড়ামুচড়ি দেখে, হারিকেনে তখনো মন্দা আলোয় সলতে জ্বলছিল। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে নিলাম, বোবার সাথে শুরু হয়ে গেছে কুরুক্ষেত্র; দিলাম কষে ধাক্কা, কাজ হলো না, আরো জোরে, তাও না, লাগাও ঘুষি, তেড়ে মেড়ে উঠে বলে- 'দোস্ত, ধরেছে'। বলি পাশ ফিরে শো' ঘুমে অস্থির আমিও। কিন্তু পারলাম কই, একটু পরেই আবার শুরু হলো যুদ্ধ; আবারো একই ওষুধ, তারপর বললাম আর ঘুমাসনে, উঠে যা, কিন্তু ওর বোধহয় উঠে বসা ও কথা বলা সবটাই ঘুমের ভেতরই চলছিল। এভাবেই বেশ কয়েক দফা লড়াইয়ের পর মনে হয় বেচারা 'ছিঁচকে বোবা' টিটুর কাছে হেক্টরের মত পরাজয় বরণ করলো। চলুন শোন যাক বুবিনীর সাথে কিভাবে আমার সাক্ষাত।

ছ'মাসের পরিভ্রমণের চেরাপুঞ্জি-কোলের দিনগুলি তখন কিছুটা ফুরিয়েছে স'বে। লুৎফাদের বাড়ী থেকে চলে এলাম, তাদের পাশের গাঁয়ে। এ বাড়ীটিও গাঙের পাড়ে; বরং লুৎফাদের বাড়ীর চাইতে আরো বেশী পাহাড়ী সুন্দর এবং তটিনি ঘেরা। থাকার ঘরের বাঁশের (অথবা টিনের বেড়া মনে পড়ছে না) বেড়াটি ছিল কৌণিকতার সংযোগে কিছুটা ফাঁকা। হাফপ্যান্ট পরা বয়স, তারোপর অস্থায়ী দীর্ঘমাসী মেহমান, এসব মিলিয়ে তখনো বাবামায়ের সাথেই ঘুমোতাম; রাতে ভয় পেলে, চৌকি থেকে পড়ে গেলে অথবা 'এক নম্বর' এলে উপায়. . . , তাই বাবামায়ের কাছাকাছি থাকা। গাঙের পাশটি ধরেই তিন কি পাঁচ কিলোমিটার দূরে 'বোগলা বাজার'; এ অঞ্চলের একমাত্র বাজার, সপ্তাহে একবার তো আমাদের যেতেই হতো, মজাই লাগতো। তো সেদিন ঘুমের ভেতরই রওয়ানা দিলাম আমি আর কাঁধ বরাবর ছোট মিঞা। আধপথে পৌঁছেই হঠাৎ শুনি সমবয়সীদের হৈ হুংকার, ব্যাপারের দিকে তাকাতেই হৃদপিণ্ড কইমাছ, ইয়া--- বড় এক বুড়ি, 'ইয়া'টা এত যে তার হাতের তালুতে আমাদের দু'ভাইয়ের জায়গা হয়ে যাবে। একটা সাদা পুরোনো কাপড় পরে, হাতে মোটা মোট দু'গাছা বালা আর একহাতে একটা কাঁসার বাটিপড়া টাইপের বাটি, আধপাকা চুল।

হাফপ্যান্ট পরা পুসকে বাহিনী পাগল তাড়ানোর মত করে ঢিলিয়ে ঢিলিয়ে বুড়ির বারটা প্রায়, বুড়ি রাস্তা ছেড়ে গাঙের পাশ দিয়ে কোনমতে ওদের থেকে পালাতে চাইছে আর বকাঝকা করে যাচ্ছে। অথচ আমরা দূর থেকে দেখেই কুপোকাত, কাতটা ঠিক কুয়োতে হইনি, পাশেই দেখলাম একটা সীমের 'মুড়া' (গোল করে লাগানো লতানো সীম গাছ) পড়িমরি করে পালাতে গিয়ে পড়লাম ওটায়; ব্যস, শুরু হলো লড়াই! ঘুম তো ভেঙ্গে খান খান, কিন্তু হাত পা, শরীর কিছুই নাড়তে পারছি না; চিৎকার করে যাচ্ছি কিন্তু শব্দ বেরুচ্ছে না মুখে; ভাবলাম মরে যাচ্ছি না তো! অন্তে বাবা টের পেলেন আর দিলেন ধাক্কা, কোন মতে বুড়ি আমাকে ছাড়লো, বাবাকে বললাম সে কি ভয়াবহ হাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে, বাবা বুঝলেন আর আচ্ছা করে বকা দিয়ে দিলেন বুড়িকে। তারপর ভয়ে, কাঁপুনিতে ধীরে ধীরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম পর্বতের পাদদেশে।

০৮.০২.২০০৭
মদীনা মুনওয়ারা, সৌদি আরব।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞ যেখানে।


৩.

স্বপ্ন থেকে চৈতন্যে আবেগী খোঁচা
-ফজলে এলাহি মুজাহিদ

স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে (ধারাবাহিক সত্য ঘটনাবলী)
=============================

মনের ভাবনারা কতদিকেই তো ডালপালা মেলে, জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে-সীমান্তে তাদের স্বরূপ-রঙরূপ হয়ে থাকে ভিন্ন থেকে বহুতর। তেমনি ব্যাপার তো আট কেলাসের রঙিন দিনগুলিতেও হতে পারে, তাই না? আরো খুলে বলতে হবে? মানে কাউকে ভাল লাগা, জীবনের জন্য চাওয়া; এইসবই তো বলতে চাইছিলাম। অবশ্য কোন কোন কবি-সাহিত্যিক যেমন তাদের ছেলেবেলার এই ভাললাগাকে প্রকাশ করেন- অপ্রাপ্ত বয়সী আবেগের সাথে; তা নিয়ে না হয় চুপই থাকি এখন।

তো যখন তাদের সুখের সংসারে দু'টো বাবু এলো, (আমি সবসময় তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন ও বাবুদের জন্য দো'আ করি; কারণ ওরা যে একদা মনে ঠাঁই করে নিয়েছিল অজান্তেই) তখন একদিন দেখি দুঃস্বপ্ন; বাবুদের বাবার এক্সিডেন্ট, রক্তাক্ত জামা, সাদা শাড়ী এবং কিছু কান্নার গুমরিত ধ্বনি। ঘুম ভেঙ্গে যায়; মনটা দারুনভাবে মুচড়ে উঠে, নিজের প্রতি ধিক্কার উঠে আসে আপনাতেই, কি স্বপ্ন দেখ্ছি আমি, কি স্বার্থপর আমি! কিন্তু আমার কি হাত আছে স্বপ্নার্জনে? আমি তো সেখানে একান্ত বাধ্যগত দর্শক মাত্র।

কষ্টিত মন আর ধিকৃত বেদনা নিয়ে পোহায়ে দিলাম রাত, দিনের সূর্য যখন এতটা উঠলো যে, বন্ধুকে ফোনে পাওয়া যাবে; তখন চাপলাম পরিচিত কিছু ফোন-কী; ওদের শহরের বন্ধু।
-হ্যালো!
-'শুনিস্ নি?', ওপাশের কথা শুনে আমার রীতিমত রক্ত হীম।
-'কি!'
-'.... ভাই এক্সিডেন্ট করেছে!'
-'কি বললি!!'
-'হাঁ, এখন হাসপাতালে আছে।', -যেন জীবনে জীবন ফিরে এল; স্বপ্ন পুরোপুরি সত্যি হয়নি অন্ততঃ।
-'কিভাবে, কোথায়, যখম কতটুকু,,,,(ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নমালা একসাথে)'।
-'আঘাত পেয়েছে, দু'একদিনেই ছাড়া পাবে আশা করি, তবে গাড়ী পুরো পেপসীর ডিব্বা হয়ে গেছে'।
-'রাখ তোর গাড়ী, বেচারা জানে বাঁচলো, এই তো অনেক পাওয়া হলো'।
আমি তখনো কেঁপে কেঁপে উঠছি স্বপ্নের রক্তরঙিন জামা কল্পনায় দেখে, অশ্রু, সাদা শাড়ী, মৃতু্য, বিরহ, বেদনা, বিদায়... ইত্যাদিতে।

বাস্তবের জেগে থাকা স্বপ্নগুলো চৈত্রীয় ঝড়ো হাওয়ায় আমের মুকুলের মত ঝরে গেলেও ঘুমঘোরের স্বপ্নমালার অনেকগুলোই অনেকাংশে জীবনের আনাচে কানাচে সত্য হয়েই চল্ছে, এবং আজো। কিন্তু তাই বলে কি জীবনকে ছুঁড়ে দিতে হবে কালের আস্তাকুঁড়ে? ধ্বংস করে দিতে হবে আরেকটি সুখের সংসার? আমি সুখী হতে পারিনি বলে ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে হবে পৃথিবীর সুখরাজি? না, এমন অজ্ঞজনোচিত ব্যাধিময় বিবেক দেননি বলে প্রভুর সকাশে জীবনময় আন্তরিক সিজ্দা এবং প্রশংসা বাণী- "আলহামদুলিল্লাহ্"। জীবনের স্বপ্ন পূরণের জন্য চাই সাধনা, অন্যথায় চাই ধৈর্য্য; চরম ধৈর্য্য। ভালবাসার অর্থ সর্বদাই যে কাছে পাওয়া হতে হবে; তা বিশ্বাস করি না এবং সমস্তটুকু এক বিন্দুতে, তাও আবার কোন মানব-মানবীতেই সীমাবদ্ধ হবে; তাও বিশ্বাস করি না। সবটুকু ভালবাসা তো হতে হবে পরম প্রিয় প্রভুর জন্য; বরং তাঁর সম্পর্কভিত্তিক ভালবাসার বিভাজন তথা তাঁর দিকনির্দেশিত জগতে ভালবাসার আবর্তন ঘটানোতেই অতীত-বর্তমান-ভষ্যিতের সুখ-সাফল্য-শান্তি নিহিত; হায়, যদি আমরা বুঝতে পারতাম; যদি পারতাম!

৩০.০১.২০০৭, মদীনা মুনওয়ারা, সৌদি আরব।

(((চলুক না আরো কিছুদূর)))

ছবির জন্য কৃতজ্ঞ যেখানে।

৪.

অদ্ভুতুড়েদের সাথে স্বাপ্নিক সংঘাত


স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে (ধারাবাহিক সত্য ঘটনাবলী)
=============================

মনে পড়ে যেভাবেঃ
ক'দিন থেকেই তো লেখালেখিকে ছুটি দিয়ে রেখেছি; কিন্তু ব্লগে এক-আধটু করে চোখ রাখতে ভুলছি না। হঠাৎ কাল চোখে পড়লো হাসিন হায়দার-এর নোটিশ: "(সামহোয়্যারইন) ব্লগ আজকে কিছুটা শ্লো থাকবে"। বাসা পরিবর্তনের ঝাক্কি সামলাতেই রাত আড়াইটা, পৌঁছে দেখি ওরা সবে ঘুমিয়ে অস্থির; যেখানে চলে নিয়মিত ভুরিভোজ। কি আর করা ডিব্বার মুড়ি-চানাচুরই হলো আপাতত ফজর অবধি সম্বল; তাই চিবুলাম বসে বসে। যথারীতি ফজরের পর ডুব দিলাম 'ঘুম-কম্বল'-এর তলে। স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে এসে দেখা দিল নতুন পোষাকী ব্লগ; ডেমরার বাঁধভাঙ্গার ছবির পরিবর্তে দেখলাম মন্দা-সোনালী পটে হাতে আঁকা লগো, যেখানে রয়েছে ডাল-পাতা; ঠিক বোঝাতে পারছি না লিখে, যদি আঁকিয়ে হতাম তো এঁকে নিতাম জেগে উঠেই। তারপর রেজিষ্ট্রেশনে দেখলাম কয়েকটি বিভাগ, যেখানে রয়েছে "ফ্রি" থেকে শুরু করে আরো দু'তিন ধারার "সাবস্ক্রিপশন সিস্টেম" এবং রীতিমত সুবিধার ব্যবধানে অর্থের বিনিময়ে। আরো কিছু নতুন পলিসি দেখলাম পোষ্টানো নিয়ে; সব মিলিয়ে অদ্ভুত আর পরিচ্ছন্ন এক স্বপ্ন দেখা হয়ে গেল। অবশ্য হাসিন কি পরিবর্তন করছেন বা করে ফেলেছেন, অফিসে আসার পূর্বে তা দেখে উঠা সম্ভব হয়নি। (বলাই বাহুল্য যে, এখন অফিস থেকে লিখছি।) (নাহঃ বাসায় এসে তেমন পরিবর্তন দেখিনি )

অদ্ভুতুড়েদের সাথে স্বাপ্নিক সংঘাতঃ
-------------------------------
স্মরণপটের জীবনটাই এমন যে, কোথাও এতটুকু আঁচড় লাগলে জীবনজোড়া সমস্ত আঁচড়গুলো ভেসে উঠে স্মৃতির পর্দায়; যদিও ব্যথা অথবা আনন্দ ততটুকু নয় যতটুকু তখন হয়েছিল। বয়সটা এমন ছিল যে, প্রিয়জনেরা তখনো কোলে তুলে নিতেন, ঘুম পাড়িয়ে দিতেন; যদিও ততবড় ছেলেকে সচরাচর কেউ কোলে নেয় না। কিন্তু না নিয়ে কি উপায় আছে, আমি যে চোখ বন্ধ করলেই এমনসব অদ্ভুতুড়ে জানোয়ার দেখতে পেতাম, যা পৃথিবীর কোথাও নেই। ওরা আমায় দারুন ভয় দেখাত, তেড়ে আসত দাঁত বের করে, থাবা উঁচিয়ে; বুক কাঁপানো সে ভয়ে আমি ঘুমুতে পারতাম না সহজেই। যদিও ঘুম পাড়িয়ে দিতেন আম্মু, খালাম্মা কিংবা নানী, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নেই ওরা এসে হাজির হত, তারপর সে-ই ভোর রাত থেকে নিয়ে সকাল অবধি ওরা ক্রমাগত ভয় দেখিয়ে চলতো। নানী তার অতি আদুরে নাতিকে নিয়ে চিন্তায় অস্থির, কি করবেন ভেবে পাচ্ছেন না, যে-ই আসতো তার কাছেই বলে বলে পরামর্শ চাইতেন। তো এলেন এক নানার দেশের নানীবুড়ি, এখন ঠিক মনে পড়ছে না তিনি কে? অবস্থা শুনে বললেনঃ "নানুভাই, যখনি ওরা তোমাকে ভয় দেখাতে আসবে, তুমি ঘুমের মধ্যেই আচ্ছা করে মেরে দেবে তাদেরকে; কি পারবে না? একবার মেরে দিতে পারলে দেখবে আর তোমাকে ভয় দেখাবে না।" অবুঝ হৃদয়ে কথাটি গেঁথে গেল।

সেদিন রাতেই স্বপ্নেঃ
------------------
সন্ধ্যা হয় হয় লগ্নে প্রায় "টেঁঠা" (আঞ্চলিকে- বাঁশের কঞ্চির গোড়ায় শিক বেঁধে মাছ শিকারের হাতিয়ার) নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাছ শিকারে। নানাবাড়ীর দহজিলের মাঝামাঝি নানাদের সীমানায় আছে দু'টো জোড়া পুরুষ তালগাছ, তার বিপরীতে পুকুরে দেখলাম সোলমাছের পোনা, একটু পর উঁকি দিল সোল মাছটিও। দেরি না করে দিলাম ঘাই, আনন্দে আত্মহারা হয়ে তুলে দেখি একি! মাছের মাথার পরে পুরো শরীরটাই যেন একটা তালপাতার পাখা; মানে তার লেজ, পানিতে তো এমন দেখিনি। ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠলো, টেঁঠাসহ মাছ ওখানেই ফেলে আস্তে আস্তে চারদিক দেখে দেখে দৌড়ে পালানোর চিন্তা করছিলাম; অমনি দেখি সেই জোড়া তালগাছের ওপাশ থেকে ধীরে ধীরে মাথা উঁচিয়ে উঠে আসছে এক বুড়ি, গায়ে শততালি দেয়া ছিন্ন বস্ত্র-চাদর, মুখে কোনরূপ শব্দ না করে সে-ই স্বপ্নে-জাগরণে দেখা অদ্ভুতুড়েদের মত করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেই আসছে!

কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না; বয়স যাই হোক তখন বাজারের চা দোকানের টিভি দেখতাম মাঝে মাঝে, এছাড়া বন্ধুদের কাছ থেকে ও স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে মারপিট-কারাতে ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতাম; তাই দিনের সেই নানীবুড়ির কথাকে মনে করে সাহসে ভর করে এগিয়ে গিয়ে ছুঁড়লাম এক উঁচানো লাথি সেই ভুতুড়ে বুড়ির চেয়াল-বুক লক্ষ্যে। তারপর আর পায় কে আমাকে, "সাহসী বীর" মোটেও পিছন ফিরে দেখার সাহস করিনি যে ভুতুড়ে বুড়ির কি হলো; দে ছুট্ এক্কেবারে কাঁথা-কম্বল নিয়ে খাটের বাইরে। অদ্ভুত আনন্দের ব্যাপার ছিল যে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই দু'চোখের পাতা থেকে অজাগতিক প্রাণীগুলো বিদায় নিল; যাদেরকে আর কখনোই দেখিনি স্বপ্নে অথবা কল্পনায়।

ছবির জন্য কৃতজ্ঞ যেখানে।

 
  Today, there have been 4 visitors (30 hits) on this page!  
 
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free